ভৈরবের সরকারি খাদ্য গুদামে মজুদে ঘাটতি, বোরো ও আমন ধান সংগ্রহে অনিয়ম এবং চাল নিয়ে চালবাজির কারণে জেলা ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকসহ গুদাম কর্মকর্তাকে শাস্তি মূলক বদলী করা হয়েছে। তারা হলেন, কিশোরগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ তানভীর হোসেন ও ভৈরব উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. শরীফ মোল্লা এবং গুদামের (ভারপ্রাপ্ত) কর্মকর্তা কামরুল হাসান। এছাড়াও খাদ্য অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক সারোয়ার মামুদের হাতে সিলগালা করা গুদাম খুলে নয়-ছয়ের সময় গেল (২২ মার্চ) রোববার বিকেলে হাতেনাতে গুদামের কর্মকর্তা কামরুল হাসান এবং গুদামের শ্রম ও সড়ক, নৌ-পথের মালামাল লোড-আনলোডের ঠিকাদার ফারদুল্লাহসহ ১০ জন শ্রমিককে আটক করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার লুবনা ফারজানা। এ ঘটনায় রাতেই আটক ১২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে খাদ্য অধিদপ্তর। মামলায় ১০ জন শ্রমিক এবং গুদাম কর্মকর্তা ও ঠিকাদারসহ ১২ জনকে গ্রেফতার দেখিয়ে পরদিন সোমবার দুপুরে কিশোরগঞ্জ কারাগারে পাঠায় থানা পুলিশ। আর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ তানভীর হোসেন ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. শরীফ মোল্লাকে শাস্তিমূলক বদলি করে বরিশাল বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানাগেছে, গেল সোমবার রাষ্ট্রপতির আদেশে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংস্থা প্রশাসন বিভাগের উপ-সচিব ড. শেখ নুরুল আলম স্বাক্ষরিত চিঠিতে জানানো হয়, মোহাম্মদ তানভীর হোসেনকে কিশোরগঞ্জ থেকে ঝালকাঠির জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে বদলি করা হয়েছে। এছাড়াও ঘটনার দিন অর্থাৎ গেল রোববারই প্রশাসন বিভাগের সংস্থাপন শাখার উপ-পরিচালক (সংস্থাপন) মামুন আল মোর্শেদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয় মুহাম্মদ কামরুল হাসানকে প্রশাসনিক কারণে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক বরিশালের অধীনে ন্যস্ত করা হলো। একই দিনে মামুন আল মোর্শেদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত আরেকটি চিঠিতে মো. শরীফ মোল্লাকে বরগুনা জেলার পাথরঘাটায় উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে বদলি করা হলো। তাদের বিরুদ্ধে সর্বশেষ অভিযোগ, করোনা ভাইরাসের পরিস্থিতিতে বড় ধরনের দুর্নীতির মাধ্যমে খাদ্য গুদাম থেকে চাল সরিয়ে ফেলেছেন।
খাদ্য অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিরত কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, অনিয়ম এবং দুর্নীতিতে কারো নাম আসলে তাকে শাস্তিমূলক বদলি হিসেবে বরিশাল বিভাগে পাঠানো হয়।
এদিকে ঘটনার দিন বিকেলে গুদাম থেকে ১২ জনকে আটক করার সময় জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ তানভীর হোসেনও উপস্থিত ছিলেন। পরে সরকারের বিশ্বাস ভঙ্গ এবং সিলগালা করা গুদাম খোলায় অধিদপ্তরের নির্দেশে রাতে তিনিই মামলার বাদী হন। কিন্তু আবার তাকে শাস্তিমূলক বদলী করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জনমনে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয় খাদ্য অফিস সূত্রে জানাগেছে, ভৈরব উপজেলায় অটো রাইচ মিল, সেমি অটো রাইচ মিল ও হাস্কিংসহ কাগজে-কলমে প্রায় ১৭টি মিল রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দুই থেকে তিনটি মিল ছাড়া অধিকাংশ রাইস মিলের কোনো অস্তিত্ব নেই। ফলে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন মিল থেকে চাল ক্রয়ের নামে একটি সিন্ডিকেট নানা অনিয়মের মাধ্যমে সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই সিন্ডিকেটের প্রভাবশালী একজন হলেন গুদামের শ্রম, সড়ক ও নৌ পথের মালামাল পরিবহনের ঠিকাদার এবং মাম অটো রাইচ মিলের মালিক মো. ফারদুল্লাহ। বাস্তবে যেসব মিলের কোনো অস্তিত্ব নেই, কিন্তু কাগজে আছে। এমন সব মিলের নামে আশুগঞ্জ থেকে নিম্নমানের চাল কিনে গুদামের সাথে লাগোয়া তার নিজের মিল থেকে বস্তায় এসব চাল ভরে গুদামে সরবরাহ করেন তিনি। একই সঙ্গে বোরো এবং আমন ধান ক্রয়েও রয়েছে তার আধিপত্য। তার অনুমতি ছাড়া এক কেজি ধানও সংগ্রহ বা কিনতে পারে না কর্তৃপক্ষ। ফলে বছরের পর বছর ধরে উপজেলার শত শত প্রান্তিক কৃষকরা সরকারের ন্যয্য মূল্যে ধান বিক্রি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাছাড়া উপজেলা ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ব্যবস্থা করায় তার এসব অনিয়ম চাপা পড়ছে। আর নানা কৌশলে ঠিকাদার ফারদুল্লাহ কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এছাড়াও গুদাম কর্মকতাকে ডিঙিয়ে নথিপত্র নিয়ে ঠিকাদার নিজেই বিভিন্ন অফিসে দৌঁড়ঝাপ করেন। শুধু তাই নয়, খাদ্য অধিদপ্তরের লোকজনের সাথেও রয়েছে তার যোগাযোগ ও সখ্যতা। ফলে যখন যেখানে যা দরকার, তখন সেখানে তা-ই দিয়ে ম্যানেজ করে ফেলেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক (ডিজি) সারোয়ার মাহমুদ মুঠোফোনে জানান, সিলগালা করা গুদাম খোলার দায়ে মামলা হয়েছে। সেই সাথে জেলা ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকসহ গুদাম কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক বদলী করা হয়েছে। তাছাড়া ঘটনার দিনই ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমটি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ঠিকাদার ফারদুল্লাহর বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত শেষে অভিযোগের সত্যতা পেলে অবই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়াও গুদামে নিয়োজিত যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মিলবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। খাদ্য গুদামের অবস্থা অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল, আমরা চাই সেখানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসুক। এরমধ্যে কেউ যদি অন্যায় করে থাকে তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে।
জানাগেছে, গেল (২১ মার্চ) খাদ্য অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক (ডিজি) সারোয়ার মাহমুদ গুদাম পরির্দশনে এসে ২ নম্বর ও ৩ নম্বর গুদামের খামালে অনিয়ম দেখেন। পরে তিনি মই দিয়ে উপরে ওঠে খামালের মাঝে ফাঁকা দেখতে পান। এসময় তিনি খাদ্য শষ্য মজুদে অনিয়ম ও চালের বস্তার ঘাটতি থাকার কারণে দু’টি গুদামই সিলগালা করে দেন। এছাড়াও গুদামের সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে ঠিকাদারের মাম নামে একটি অটোরাইচ মিলে অবাধ চলাচলের জন্য রাস্তা দেখতে পান তিনি। পরে রাস্তাটি দ্রুত বন্ধের জন্য কিশোরগঞ্জ জেলা খাদ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ তানভীর হোসেনকে নিদের্শ দেন মহা-পরিচালক সারোয়ার মামুদ। পরের দিন (২২ মার্চ) রোববার জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মোহাম্মদ তানভীর হোসেন গুদামে বিকেলে এসে সিলগালা করা গুদামের তালা ভেঙ্গে ভেতরে শ্রমিকরা কাজ করছে এমন দৃশ্য তার নজড়ে পড়ে। এ বিষয়ে তিনি জানতে চাইলে গুদামের ঠিকাদার ফারদুল্লাহ এবং গুদামের (ভারপ্রাপ্ত) কর্মকর্তা কামরুল হাসান তারা কোন সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। পরে বিষয়টি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মুঠোফোনে মহা-পরিচালক সারোয়ার মাহমুদকে অবহিত করেন। পরে খাদ্য অধিদপ্তরের নির্দেশে পুলিশ সদস্য নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার লুবনা ফারজানা গুদামে হাজির হয়। এসময় সিলগালা করা গুদামের তালা ভেঙ্গে ভেতরে শ্রমিক দিয়ে ঘাটতি পূরণের সময় ১০ জন শ্রমিকসহ ঠিকাদার ফারদুল্লাহ ও গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামরুল হাসান আটক করেন। সেই সঙ্গে পুনরায় গুদামটি সিলগালা করে দেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার।