• শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫, ০২:২২ অপরাহ্ন |
  • English Version

বাংলাদেশ রেলওয়ে নিয়ে ভাবনা

ঢাকা বিমান বন্দর রেলওয়ে স্টেশনের ছবি। - ফাইল ফটো

আমি বাংলাদেশ রেলওয়ের একজন নিয়মিত যাত্রী। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সেবাখাতগুলোর মধ্যে রেল অন্যতম। আমার কাছে মনে হয় সকল শ্রেণির যাত্রী পরিবহনে যতো ধরণের মাধ্যম রয়েছে তার মধ্যে রেলওয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয়, পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ, আরামদায়ক ও কম ব্যয়বহুল। সারা দেশে রয়েছে এর যোগাযোগ নেটওয়ার্ক। যার দ্বারা একসাথে অধিক সংখ্যক যাত্রী পরিবহন করা সহজসাধ্য। এছাড়াও পণ্য ও পার্সেল পরিবহনে রেল একটি নির্ভরযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে এই রেলওয়েকে নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের কথাও সচেতন দেশবাসির কাছে অজানা নয়। দেশের নানা প্রান্তে নানান সময়ে রেল সংকোচনের মাধ্যমে রেল সেবা বন্ধ করে দেবার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি জনবল সংকটের কথা বলে (নতুন জনবল নিয়োগ না করে) ১৯৯৭ সাল থেকে রেলওয়ের ভৌত সকল অবকাঠামো ব্যবহার করার সুবিধা দিয়ে (নির্ধারিত কিছু শর্তে) বেসরকারি কোম্পানির হাতে বেশ কিছু ট্রেনকে যাত্রী, পণ্য ও পার্সেল পরিবহনের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশে ৩৭টি ট্রেন বেসরকারি খাতে পরিচালনা করা হচ্ছে। ক্যাটারিং, ট্রেনের আসনের রিজার্ভেশন ও টিকেটিং ব্যবস্থা, প্রধান রেলপথসমূহে ফাইবারঅপটিক কেবল স্থাপন, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ বেসরকারি সংস্থার হাতে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে কোচগুলোর এটেনডেন্ট নিয়োগ করা হচ্ছে।
এর মাঝেও স্বস্তির বিষয় হলো, রেলে নতুন নতুন ইঞ্জিন, আধুনিক সুবিধা সম্বলিত কোচ সংযোজন, সিগন্যালিং সিস্টেমের আধুনিকায়ন এবং হালে কিছু কিছু পথে ডাবল লাইন চালু করা রেলওয়েকে নতুন গতি দিয়েছে। দেশের নদীগুলোর নাব্যতা কমে যাওয়ায়, সড়ক পথে অতিরিক্ত গাড়ির চাপ থাকায় রেলের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এছাড়াও রেল পরিচালনায় নিয়োজিত রয়েছে বহুসংখ্যক কর্মচারী, যা দেশের কর্মসংস্থানের একটি বড় সেক্টর। এতোসব সুবিধা থাকা সত্ত্বেও রেলের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা যেন পিছু ছাড়ছে না। নিম্নে যাত্রী হিসেবে এর দৃশ্যমান কয়েকটি সমস্যা ও পরে এর সমাধানে কিছু পরামর্শ তুলে ধরাছিÑ
* অগ্রিম টিকেটিং সিস্টেম : অনলাইন সিস্টেমে ট্রেনের টিকিট রিজার্ভেশন ব্যবস্থা এবং এ নিয়ে নানা পদক্ষেপ (যাত্রীর মোবাইল নাম্বার রেজিস্ট্রেশন, একজন যাত্রীর সর্বোচ্চ ৪টি টিকেট ক্রয়, টিকেট বাতিল, ওটিপি ইত্যাদি) অত্যন্ত যুগোপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রতি টিকেট প্রতি অতিরিক্ত ২০ টাকা সার্ভিস চার্জ আরোপ (যা রাজস্ব খাতে যোগ হয়না) একধরণের লুটপাটের মহোৎসব বলে মনে করি। কারণ অনলাইনে টিকেট বুকিং দেয়ার ক্ষেত্রে যাত্রী তাঁর মোবাইল/কম্পিউটার, মোবাইল ডাটা, অনেকক্ষেত্রে টিকেট প্রিন্টিং করার জন্য প্রিন্টার ও কাগজ নিজেই বহন করে। তাহলে কেন এই অতিরিক্ত ২০ টাকা যাত্রীর পকেট থেকে কাটা যাবে?
* রক্ষণা-বেক্ষণ : ট্রেনের যাত্রী কোচগুলো (দু’একটি ট্রেন ব্যতীত) অপরিচ্ছন্ন, ভেতরে লাইট-ফ্যান-এসি নষ্ট, দরজা-জানালা-হেঙ্গার ভাঙ্গা, বাথরুমের পানির কল, লাইট, বদনা, কমোড ইত্যাদি অবস্থা এতোটাই শোচনীয় যে, বলতে গেলে তা একেবারেই ব্যবহারের অনুপযোগী।
* পরিচালন : ট্রেনগুলো যথাসময়ে যাতায়াতের এখনো পূর্ণাঙ্গ নিশ্চয়তা নেই। স্টেশনের অপর্যাপ্ত ডিসপ্লে বোর্ডগুলোও প্রায়ই নষ্ট থাকে। ডিসপ্লে বোর্ডগুলোতে পর্যায়ক্রমিক ট্রেনগুলোর আগমণ-প্রস্থানের কোনো নির্দেশনা নেই। ট্রেনের কোচের নাম্বার প্লেট নষ্ট অথবা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অস্পষ্ট, কখনো কখনো চক/খড়িমাটি দিয়ে হাতে লেখা, আবার একই সাথে বেশ কয়েকটা অক্ষর লেখাও দেখতে পাওয়া যায়। ট্রেনের ভেতরে যাত্রীদের সতর্কতামূলক কোনো এনাউন্স করা হয় না। এমনকি যাত্রীদের ওঠা-নামার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ট্রেনেই এনাউন্স করা হয় না। প্রান্তিক স্টেশন ব্যতীত ট্রেনগুলো অন্যান্য স্টেশনে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে কখনো প্ল্যাটফরমের নির্ধারিত স্থানে দাঁড়াতে পারে না। এতে যাত্রী পূর্বদিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে যে জায়গায় কোচের জন্য অপেক্ষা করেন, পরেরদিন হয়তো সে কোচটি বেশ খানিকটা আগে অথবা পিছে চলে যায়। এতে যাত্রীদের ট্রেনে ওঠার জন্য দৌড়া-দৌড়ি ও হুড়াহুড়ি করতে হয়।
* অবাঞ্ছিত ব্যক্তি : দেশের প্রায় প্রত্যেকটি স্টেশন ও ট্রেনে ভিক্ষুক/হিজড়া ও হকারদের ব্যাপক দাপট। তাদের অত্যাচারে যাত্রী সাধারণ অনেকসময় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তাছাড়া স্টেশনগুলোতে ভবঘুরে, পকেটমার, ছিনতাইকারী, টোকাইদের ব্যাপক দৌরাত্ম রয়েছে।
* স্ট্যান্ডিং টিকেট : রেলের পূর্বাঞ্চলের দূরপাল্লার ৩টি ট্রেন (সোনার বাংলা, কক্সবাজার একপ্রেস ও সূবর্ণা) ব্যতীত দেশের সকল ট্রেনেই যাত্রাবিরতির ব্যবস্থা রয়েছে। সে সকল ট্রেনে বাধ্য হয়ে টিকেটের বাইরেও স্ট্যান্ডিং টিকেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পূর্বে শতভাগ স্ট্যান্ডিং টিকেট দিলেও বর্তমানে তা ২৫% করা হয়। এতে করে স্ট্যান্ডিং যাত্রীদের ৭৫% ভাগ টিকেটবিহীন অবস্থায় ট্রেনে চড়ে। ট্রেনের ভেতর টিটিই/টিটিসি সাহেবরা ট্রেনে অবস্থান করলে (সব সময় তাদেরকে দেখতে পাওয়া যায় না) টিকেট প্রতি মূল ভাড়ার অতিরিক্ত জরিমানাসহ আদায় করেন (তবে টিকেটবিহীন ৭৫% শতাংশ যাত্রীর সকলকে তাদের পক্ষে চেক করা সম্ভব হয় না)। এক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি (এটেনডেন্টদের মাধ্যমে) জড়িত।
* এটেনডেন্ট : আউট সোর্সিং এর মাধ্যমে নিয়োগকৃত এটেনডেন্টরা যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা দেখার পরিবর্তে কখনো টিটিই/টিটিসিদের এজেন্ট হিশেবে, কখনো নিজেই যাত্রীদের কাছ থেকে টিকেট চেক করা ও ভাড়া (যার কাছ থেকে যতো নিতে পারে) তুলতে ব্যস্ত থাকেন। কখনো কখনো যাত্রীদের সাথে তারা দুর্ব্যবহারও করেন।
* ক্যাটারিং : প্রত্যেক ট্রেনে একটা খাবার কোচ থাকে। কিন্তু সেখানে বসে কোনো যাত্রী কিছু খেতে পারেন না। কোচটি যতগুলো আসন ও টেবিল রয়েছে সবগুলো ক্যাটারিং-এ নিয়োজিত কর্মচারীরা টিটিই/টিটিসিদের যোগসাজুসে বিনা টিকেটের যাত্রীদের বসার ব্যবস্থা করেন। এমনকি ওয়াকওয়েতে মোড়া, ক্যারেট, পানির বোতলের প্যাকেট ইত্যাদির মধ্যে বসিয়ে টিকেটের দ্বিগুন ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এছাড়াও তারা সারা ট্রেনে ঘুরে ঘুরে এটেনডেন্টদের সহায়তায় বিনা টিকেটে চড়া যাত্রীদের খালি সিটসমূহে বসানোর ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত থাকেন। ট্রেনগুলোতে খাবারের মান অত্যন্ত নিম্ন মানের, কিন্তু দাম অত্যন্ত উঁচু। এক কাপ রং চা ১৫ টাকা, দুধ চা ২০ টাকা, কফি ৩০ টাকা। এক কাপ রং চা বানানোর খরচ হিসাব করলে (কাগজের কাপ- ১ থেকে ১.৫০ টাকা+১টি টি ব্যাগ ১টাকা+চিনি (অনেকে চিনি খান না) .৫০ টাকা+গরমপানি= ৩ টাকা)। সেক্ষেত্রে ১৫ টাকা! দাম নেয়া তো ডাকাতির পর্যায়ে পড়ে!
* ছাপানো টিকেট : আসনবিহীন ছাপানো টিকেটের ক্ষেত্রে জাল টিকেটের বিষয়টি অনেক পুরাতন। যা অনেকটা জাল টাকার মতোই। তাও টাকাতো হাত বদল হয়, ব্যাংকে যায়। ফলে কখনো না কখনো তা ধরা পড়ে। কিন্তু রেলের টিকেট তো অল্প সময়ের ভ্রমণের জন্য। যার ভ্যালিডিটি ট্রেন থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যায়। ফলে এ নিয়ে কারো মাথা ব্যাথার কারণ নেই।
আমি দৃশ্যমান উল্লিখিত সমস্যাগুলো নিম্নোক্ত সমাধানের সুপারিশ করছিÑ
* অগ্রিম টিকেট বুকিং এর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ২০ টাকা নেয়া বন্ধ করতে হবে।
* প্রতিটি ট্রেন প্রান্তিক স্টেশনে পৌঁছানোর পর এর যথাযথ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হবে। ট্রেনের ইঞ্জিনিয়ারগণ ইঞ্জিনসহ এসি সিস্টেম, লাইট-ফ্যান, দরজা-জানালা-হ্যাঙ্গার ইত্যাদি চেক করবেন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার করবেন। ট্রেন ছাড়ার কমপক্ষে আধাঘণ্টা পূর্বে মশা নিরোধক স্প্রে, ক্ষেত্র বিশেষে এয়ার ফ্রেশনার ব্যবহার করবেন।
* যথাসময়ে ট্রেন ছাড়ার ব্যবস্থা করবেন। দেশের সকল স্টেশনে পর্যাপ্ত ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড স্থাপন করতে হবে। ডিসপ্লে বোর্ডে বর্তমান ট্রেন ও পরবর্তী অন্তত দুটি ট্রেনের আগাম খবর দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। স্টেশনের মাইক/সাউন্ট সিস্টেমকে আরো ম্যালোডিয়াস করতে হবে। ট্রেনের চালককে ট্রেনটি নির্ধারিত স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের নির্ধারিত স্থানে দাঁড় করাবার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এ নিয়ে কিছু দিন পূর্বে বেশকিছু স্টেশনে কোচ নং সম্বলিত বোর্ড স্থাপন করা হয়েছিলো, যা বর্তমানে নেই। তা পুনস্থাপন করতে হবে।
* ধুমপায়ী, হকার, অবাঞ্ছিত ব্যক্তি ও ভিক্ষুকদের সতর্ক করে নিয়মিত এনাউন্স করতে হবে। এক্ষেত্রে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর টহল জোরদার করে তাদেরকে স্টেশন থেকে বের করে দিতে হবে।
* দূর পাল্লার বিরতীহীন ট্রেন ব্যতীত সকল ট্রেনে ১০০ ভাগ স্ট্যান্ডিং টিকেটের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে স্ট্যান্ডিং টিকেটের মূল্য আসনযুক্ত টিকেটের ৭৫% করতে হবে। কারণ তারা টিকেট কেটেও দাঁড়িয়ে যাবে। তারপরও যারা টিকেট কাটবে না, তাদেরকে মূল টিকেটের মূল্যসহ দ্বিগুন ভাড়া আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেক ট্রেনে প্রত্যেক দিন টিটিই/টিটিসি দ্বারা টিকেট চেক করার ব্যবস্থা করতে হবে। স্ট্যান্ডিং টিকেট কাটার জন্য কাউন্টারের পাশাপাশি ভ্যান্ডিং মেশিনটি দ্রুত চালুর ব্যবস্থা করতে হবে এবং দেশের প্রতিটি স্টেশনে ভ্যান্ডিং মেশিন বসানো ব্যবস্থা করতে হবে।
* এটেনডেন্টরা গাড়িতে ছাড়ার পূর্বেই তার নির্ধারিত কোচ নাম্বার, দরজা-জানালা-হ্যাঙ্গার, এসি-লাইট-ফ্যান ঠিক আছে কি না চেক করবেন। তারা কোনোভাবেই যাত্রীদের টিকেট চেক করা কিংবা কোনোরূপ ভাড়া আদায় করতে পারবেন না।
* খাবার কোচের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য কোনো যাত্রীকে খাবারের পর পরই তার নির্ধারিত আসনে ফিরে যাবার ব্যবস্থা নিতে হবে। টিকেট বিহীন কোনো যাত্রীকে খাবার কোচে বসার ব্যবস্থা করা যাবে না। খাবারের মান বাড়াতে হবে এবং এর মূল্য অবশ্যই কমাতে হবে। কর্মচারীদের সাড়া ট্রেনে খালি আসন খুঁজে বেড়ানো কিংবা অবৈধ অর্থের বিনিময়ে যাত্রীদের ওঠানো সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে।
* ছাপানো টিকেট একদম বন্ধ করে দিতে হবে। বর্তমানে দেশের প্রায় সকল স্টেশনেই বিদ্যুৎ রয়েছে। যে সকল স্টেশন এখনো অনলাইন সিস্টেমে আসেনি দ্রুত সেগুলোকে অনলাইনের আওতায় আনতে হবে।
উল্লিখিত সমস্যা ও সমাধানের বাইরে আরো অনেক বিষয় থাকতে পারে বা রয়েছে। আমি শুধু আমার চোখে দৃশ্যমান বিষয়গুলো এখানে তুলে ধরলাম। তাই কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান, দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান সকল সমস্যা/ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে রেলকে তার গতিতে চলার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। কারণ রেল বাংলাদেশ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সেবা খাত। এর রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের সকলের দায়িত্ব।
লেখক : সাইফুল ইসলাম সেকুল
ভৈরব, কিশোরগঞ্জ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *